বাসা (ইস্কাটন) থেকে যতক্ষণ লাগছে এয়ারপোর্ট যাইতে তত সময়ই লাগছে জিয়া আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থিকা সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে যাইতে। দুই ঘন্টা পনেরো মিনিট।
ইমিগ্রেশন শেষ কইরা নীচ তলায় নামলাম। ইমিগ্রেশনে কোন ঝামেলা নাই। ওদের এয়ারপোর্ট নিচে তিন তলা। একটা থাই সীম নিলাম ৩০০/- থাই বাথ দিয়া। (মানে ৭৮০/- প্রায়)! কিউট লেডী বিক্রেতারে কইলাম আমারে টকটাইম না দিয়া খালি সোস্যাল প্যাক দেন। সে ৪.৫ জিবি ডাটা দিলো। জিপির এই সীম কিন্যা আপ্নে সাত দিনের মইদ্যে মইরা গেলে খুশিতে লাফাইবেন। কারণ, জীবনবীমা ফ্রি 😂।
এয়ারপোর্টের নিচতলায়ই পাতায়ার বাস কাউন্টার। টিকেট ১২০/- ট্যাকা মাত্র! (থাই টাকা আরকি! বাংলায় ৩০০/- প্রায়)। এয়ারপোর্ট থিকা পাতায়া +/- ১৫৭ কিলোমিটার! বাসের জন্য আজাইরা দুই ঘন্টা অপেক্ষা না কইরা ঘুরতে লাগলাম এয়ারপোর্টের “যেদিকে দুচোখ যায়”।
বাস যদি ফাইভ স্টার হওয়ার নিয়ম থাকে তাইলে এইটা ফাইভ স্টার বাস। এসি ত আছেই, সীটে বসলে মনে হয় কোন স্বাস্থ্যবান মহিলার কোলের উপর বসছি। এছাড়াও একটা টয়লেট আছে। “বাসের ভিতরে টয়লেট” ব্যাপারটা একটু নতুন তো, তাই সেইটা ব্যবহারের চিন্তা করতেছি। কিন্তু জায়গা চেঞ্জ হইলে আমার সকল প্রকার প্রাকৃতিক কাজ অতিপ্রাকৃতভাবে বন্ধ হইয়া যায়। তাই মনের আশা অপূর্ণ থাকলো!
ব্যাংকক থিকা পাতায়া সোজা রাস্তা। সোজা মানে এক্কেবারে সোজা। যেইসকল ইঞ্জিনিয়াররা রাস্তাটা বানাইছে তারা বোধয় এই “সোজা রাখার” ব্যাপারটারে তাদের দক্ষতার মাপকাঠি হিসাবে নিছিলো। অবশ্য এইখানের প্রায় সকল রাস্তাই যথাসম্ভব সোজা। কোন জ্যাম নাই কোথাও। এই রাস্তাটা কখনো রাস্তা থাকে আবার কখনো ফ্লাইওভার হয়া যায়। কিন্তু আমাদের বাস ড্রাইভারের কোন তাড়া নেই। উনি হেলেদুলে যাচ্ছেন। দীর্ঘ দুই ঘন্টা পরে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পাতায়া আসছি। হানিফ বা শ্যামলী এই রাস্তা পাইলে ৩০ মিনিটে নিয়া আসতো। আমি বসছিলাম পিছেনের সীটে। কিন্তু কখনো মনে হয় নাই যে আমি পিছনের সীটে আছি।
পথে প্রচুর ফ্লাইওভার দেখলাম। ডাবল, ত্রিপল লেনের ফ্লাইওভার। কালারফুল ফ্লাইওভার। মানে পীচটা লাল অথবা বেগুনি! এগুলা আমাদের প্রধানমন্ত্রী একবার উদ্বোধন করা শুরু করলে ২০৪১ সাল শেষ হয়া যাইতো; কিন্তু উদ্বোধন আর শেষ হইতো না। মাঝেমাঝে কিছু ফ্লাইওভার দেখলাম “কোথাও কেউ নাই!” এগুলো ক্যান বানায়া রাখছে কে জানে?! কিছু আমাদের দেশে রপ্তানি করলেই তো পারে! আমরা চড়া দাম দিতাম!
পাতায়ায় গরম। অথচ ঢাকায় তীব্র শীত ছিলো। ১৭/০১/১৮
আমরা যখন পৌছাই, তখন সন্ধ্যা। বিমানে বাতাসের চাপে পাশেরজনের কান বন্ধ হয়া আছে। উনারে কইলাম, নাক-মুখ চাইপা কান দিয়া বাতাস ছাড়েন। কান খুইলা যাবে। সে কয়েকবার ট্রাই কইরা কইলো, কান দিয়া তো বাতাস বাইর হয় না। কিন্তু নিচ দিয়া প্রচুর বাইর হইতাছে। সম্ভবত কানের বদলে পেট খুলছে। 😜
আমি নাক চাইপা ধইরা গুগোল ম্যাপ খোললাম। বিদেশের সবচে বিশ্বস্ত পথ প্রদর্শক এইটা। হোটেল থিকা বীচ ১৫ মিনিটের পায়ে হাটা পথ।
ও ভালো কথা! আমি তো সলো ট্রাভেলার। একলাই ঘুরি। বিমানের পাশের সীটে এমনই একজনরে পাইলাম যে একা। আমি পাতায়ায় বাংলাদেশি ৭০০-৮০০/- টাকা দামের হোটেল খুঁজবো প্ল্যান করছিলাম। কিন্তু পাশের জন আগেই ৩৫০০/- টাকা দামের থ্রি স্টার হোটেল দেশ থেকেই বুকিং দিয়া আসছিলেন। উনার সাথে আরও একজন ফ্রিতে যেহেতু রাখা যাবে আমি ৫০০ বাথ দেওয়ার চিন্তা করে ওনার সাথেই উঠে গেলাম। হোটেলে এসেই মনটা ফ্রেশ হয়ে গেলো। মনেই হচ্ছে না এতোদূর একা একা ঘুরতে চলে আসছি।
বীচে যাওয়ার বিভিন্ন রাস্তা। আবার এইসব রাস্তাকে ঘিরেই হোটেল এবং মাসাজ (শরীর টেপাটিপি) সেন্টার। এরমধ্যে walking street নামের যেই রাস্তাটা আছে সেইটা পৃথিবীর অশ্লীলতম রাস্তা। দুইপাশে শুধুই ডিসকো সেন্টার। সেগুলার সামনে প্রায় কাপড়চোপড় ছাড়া মেয়েরা বসে/কাত হয়ে/দাঁড়িয়ে আছে। এই রাস্তা দিয়ে একবার নিরাপদে পার হওয়ার পর তার জন্য জান্নাত আবশ্যক হইয়া যাওয়ার কথা। কারণ রাশিয়ান, কম্বোডিয়ান, ভিয়েতনামীয়ান, থাই সহ বিভিন্ন দেশের সুন্দ্রী মেয়েরা গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে ছেলেদের। এঁদের উপেক্ষা করা কম ঈমানী যজবার ব্যাপার না। অবশ্য ”গোপন সমস্যা” থাকলে ভিন্ন কথা!
পাতায়া জুড়ে বুইড়া ইউরোপিয়ান দেখবেন প্রচুর। হুইল চেয়ারেও ঘুরতেছে অনেকে। তাদের পিছে সাহায্য করতেছে থাই মেয়েরা। এরা পিতা-মেয়ে না কিংবা ট্যুরিস্টদের “ফাও ফাও” হেল্প করতেছে তাও না!
পাতায়ার দর্শনার্থীদের মধ্যে সবচে বেশী দেখা যায় আমাদের ইয়া হাবিবি এরাবিয়ান নাদুসনুদুস ভাইদের। এঁদের আরবী শুনে আবার পায়ে লুটায়া পইড়েন না। এরা আসে মৌজ-মাস্তি করতে। প্রকৃতির প্রতি এঁদের কোন আকর্ষণ নাই।
এরপরে শীতের অতিথি পাখির মতো আসে ইউরোপিয়ানরা। ওদের ওখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা হওয়ার কারণে এরা থাই গরম হাওয়া খেতে আসে, থাকেও ১/২ মাস ব্যাপী। এরপরে ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট। এরা কথা কম বলে, কাজও কম করে; দেখে বেশী।
পাতায়াকে আপনি কিভাবে উপভোগ করবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার আর্থিক সামর্থ্য আর মানসিকতার উপর। তবে পাতায়া নাম শুনলেই “ছিঃ” করে উঠার উপযুক্ত কোন কারণ নাই। এইখানে নির্মল আনন্দ নেওয়ার মতো উপকরণের অভাব নেই।
থাইল্যান্ড জুড়ে কিছু খাবার পাওয়া যায় যার গন্ধ এবং চেহারা দেখলে আপনি আমার চেয়েও বেশী অসুস্থ হতে পারেন। বিচ্ছু (Scorpion), তেলাপোকা, ঝিনুক, গুবড়েপোকা সহ অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর দর্শন সব পোকামাকড় ভাজা পাবেন প্রায় সব রাস্তায়। একেকটা থাই একেকটা বেয়ার গ্রিলস। খাওয়ার জন্য আমরা খুঁজে খুঁজে বাঙালি বা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে যেতাম। একটা “আসল তরকারি” নিয়ে দুইভাগ করে ডাল/সবজী দিয়ে কাজ সারাতাম।
পাতায়ায় পানির চেয়ে হিসুর দাম বেশী। এক বোতল পানি ২০ বাথ, অথচ হিসু করতে লাগে কোথাও কোথাও ৫০ বাথ পর্যন্ত।
রাস্তাঘাটে চলতে বাইক ভাড়া পাওয়া যায় চড়া দামে। এরচে আমাদের পুলিশের গাড়ির মতো দেখতে জীবগুলারে ওরা টুকটুক বলে; ভাড়া যেখানেই যান ১০ বাথ। সারা শহর ঘুরলেও। স্পীড- বাপরে!
পাতায়া কিংবা ব্যাংকক, সর্বত্র মেয়েদের আধিপত্য। বাসের কন্ডাকটর থেকে রেস্টুরেন্টের ওয়েটার সবই মেয়ে। এঁদের উন্নতির মূল হইতেছে এই মেয়ে। ট্যুরিস্ট আকর্ষণও এই মেয়েই।
(নারীবাদিরা খুশি হবে শুইনা)
তবে এইখানে কারও একা আসা ঠিক না। নিজেরে এলিয়েন লাগবে। যদিও ভয়ের কোনই কারণ নাই। ইন্ডিয়ার মতো দালাল নেই। আর বাঙালি হিসেবে আপনার দিকে “সাধারণত” কেউ ফিরেও তাকাবে না। 😞
ঘুরতে চাইলে পাতায়ায় বীচ ছারাও কোরাল আইল্যান্ড আছে। এইটা জাস্ট আরেকটা সুন্দর বীচ। এইখানে গেলে দেখবেন “বিদেশি সিনেমা”র মতো সাদা মানুষরা খালি গায়ে শুয়ে রোদ পোহাইতেছে একটু কালো হওয়ার জন্য। এঁদের দেইখা মনে হয় ফেয়ার এন্ড লাভলী ওয়ালারা সাদা হওয়ার ক্রিমের পাশাপাশি কালা হওয়ার ক্রিম বাইর করলে আরও বেশী দামে বিক্রি করতে পারতো।
আমরা কোরাল আইল্যান্ড গিয়েছি একটা ৪০০/- বাথের প্যাকেজে, স্পীডবোটে করে। স্পীডবোটের গতি রকেটের চেয়ে সামান্য কম হতে পারে। যাত্রাপথে আমাদের প্যারাসেইলিং করার সুযোগ দেওয়া হয়। প্যারাসেইলিং মানে আপ্নারে একটা নরম দড়ি দিয়া বাইন্ধা প্যারাস্যুটের সাথে ঝুলায়া দিয়া একটা স্পীড বোটে কইরা সাগরের উপ্রে ঘুরাইবো। ব্যাপারটা এক্সাইটিং! খরচা মাত্র ৫০০/- বাথ। আমাদের কক্সবাজারে ইদানীং এইটা চালু হইছে।
এছাড়া আরেকটা জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেখান থেকে অক্সিজেন মাস্ক আর সিলিন্ডার কাধে নিয়ে গভীর সমুদ্রে সুইসাইড করার সুযোগ পাওয়া যায়। তবে সবাই ব্যর্থ হয় অবশ্য। এই ডাইভ দিতে খরচা হয় ১২০০ বাথ (৩১০০/-)! টাকা থাকলে আমি একবার ঝাপ দিতাম গভীর সমুদ্রে, ওরাই ছবি/ ভিডিও করে রাখতো। গভীরে গিয়ে মাছ দেখা যায়, সাথে একজন স্বল্প পোষাক পড়া গাইডও থাকে। (ছেলে গাইড 😭😭)
এরপরে কোরাল আইল্যান্ড। পানি এতোই স্বচ্ছ যে গলা সমান পানিতে নেমেও আন্ডারওয়ার্ল্ড দেখা যায়, এমনকি পায়ের পাতাও! জ্বর নিয়েই আমি নামছি, লাফাইছি, জয় করছি, জ্বর বাড়াইছি!
কক্সবাজার থেকে এই বীচ অনেক বেশী সুন্দর। যারা বলে কক্সবাজার সেরা তারা আজাইরা দেশপ্রেম দেখায়। কক্সবাজার এর বীচ সবচে বড়, কোরাল আইল্যান্ড চুনুপুটি। কিন্তু মাদী হাতি আর বাচ্চা হরিন তো এক না! এর পানি হাতে নিলেও মনে হবে নীল মেশানো আছে। কক্সবাজারের সাগর সাহেবের মতো হুমকি ধমকি এখানে পাবেন না, তবে যথেষ্ট ভদ্রভাবে ঢেউ আসবে, ভালো লাগবে। তবে আমাদের কক্সবাজার চাইলে এরচে অনেক সুন্দর করে রাখা যাইতো! এইটা কইলাম এম্নেই আরকি! “কক্সবাজার সুন্দর না” বললে তো আপ্নেরা ক্ষেইপা যাইবেন, তাই!
কোরাল আইল্যান্ড থিকা ফেরার পরে দেখি পাতায়া বিচে আমার একটা টম ক্রুজ মার্কা ছবি তুলে সুন্দর করে বাধায়া রাখছে। দাম মাত্র- ১০০/- বাথ! (২৫০/- টাকা). স্মৃতি হিসেবে নিয়া আসছি। (বউ কাউরে দেখাইতে না করছে) 😉
পাতায়ায় আরও আছে “টাইগার জু”। বাঘের গলায় হাত দিয়ে ছবি তুলতে পারবেন। তাছাড়া আছে মজার Repleys Believe it or Not জাদুঘর। আরও আছে পাতায়া “ফ্লোটিং মার্কেট”! ভাসমান এসব মার্কেটে পাবেন ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি। দেখার মতো জায়গার অভাব নেই পাতায়ায়। গুগল করে সেরা স্থানগুলো আগেই বাছাই করে রাখতে পারেন।
→ যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি নষ্ট করবেন না।
→ ওরা প্রায় সবাই খুবই হেল্পফুল। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলুন, আপনারও ভালো লাগবে।
********
ভিসা—
আপনার একাউন্টে লাখের উপ্রে টাকা থাকা লাগবে। তিন মাসের ভিসা দেয় ওরা। মোটামুটি চাইলেই দেয়।
খরচা—
বিমানের টিকেট ১ মাস আগে কাটছি—- ১৬০০০/- (রিটার্ন)
হোটেল ভাড়া (দুই রাতের জন্য) — ২৫০০/- (শেয়ারে 3★)
খাওয়া+দাওয়া (নাস্তা ফ্রি ছিলো) ৪ বেলা — ১১০০/-
অন্যান্য ট্রান্সপোর্ট (এয়ারপোর্ট ফেরা সহ)—- ১০০০/-
কোরাল আইল্যান্ড ট্যুর (দুপুরে ফ্রি ব্যুফে) —- ১২০০/-
মোট —- ২১৮০০/-
★ সাধারণ জ্ঞান— পাতায়া থাইল্যান্ডে অবস্থিত!
লিখেছেন – Aiman Saad
খুব সুন্দর লেখা।
অসাধারণ লাগলো। লেখক অত্যন্ত মজার মানুষ। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।